কক্সবাজার, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

মিয়ানমারে অভ্যুত্থান, তারপর কী

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ১৯৯০ সালের নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক (এনএলডি) থেকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের গ্রেপ্তার করে স্টেট ল অ্যান্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিলের (এসএলওআরসি) মাধ্যমে তাদের শাসন অব্যাহত রেখেছিল।

১ ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে ঠিক সে রকম ঘটনাই আবার ঘটল। দেশটির প্রকৃত নেতা সু চি, তাঁর দলের মন্ত্রী ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো। সামরিক বাহিনী দেশটির শাসনভার নিজের হাতে নিয়ে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করে সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করল। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হলো সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জেনারেল মাইয়িন্ত সুইয়ের নাম। যে উর্দিধারী লোকেরা ১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার শাসন করেছেন এবং তারপর বেসামরিক রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি এক দশক ধরে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটতে দিয়েছেন, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁদের ঘৃণা স্পষ্ট হলো।

বিজ্ঞাপন

গত নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি পার্লামেন্টের ৪৭৬টি আসনের মধ্যে ৩৯৬টিতে জয়ী হয়, আর সেনাপন্থী রাজনৈতিক ফ্রন্ট ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি পায় মাত্র ৩৩টি আসন। সামরিক বাহিনী তৎক্ষণাৎ ভোট কারসাজির অভিযোগ তোলে, কিন্তু নির্বাচনের এই ফল সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার জন্য তেমন হুমকি হয়ে ওঠেনি। ২০১১ সালের আগের সংবিধান অনুসারে মিয়ানমারের পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত ছিল, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর ওপরও তাদের কর্তৃত্ব ছিল এবং বিদেশি নাগরিকদের বিয়ে করেছেন, এমন ব্যক্তি বা তাঁদের সন্তানদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা ছিল না। সে কারণেই সু চি নির্বাচিত হয়েও মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি।

এ পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালের নির্বাচনে সু চি ও তাঁর দল ক্ষমতায় আসে। আর দলটির অধিকাংশ নেতাই যেহেতু রাজবন্দী ছিলেন, তাই তাঁর সরকারটি ছিল কার্যত সাবেক রাজবন্দীদের একটি জোট। এভাবে মিয়ানমারে স্পষ্টতই গণতন্ত্রের অগ্রগতি হচ্ছিল না। কিন্তু সেই অগ্রগতি এবার ভীষণভাবে ধাক্কা খেল। নতুন নির্বাচিত পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনটি যেদিন বসার কথা ছিল, ঠিক সেই দিনটিতেই সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান করল।

মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অধিকাংশ সময়ই সেনাবাহিনীর দ্বারা শাসিত হয়েছে। অং সান সু চিকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল মোট ১৫ বছর। সেই বন্দিদশা থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে ২০১০ সালের নভেম্বরে। তারপর তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেশ পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু সেই ভাগাভাগিমূলক সহাবস্থানের সম্পর্কটি মসৃণ ছিল না; বরং সু চির দেবীসুলভ জনপ্রিয়তা আর সেনাবাহিনীর অজনপ্রিয়তার কারণে সম্পর্কটি জটিল হয়ে উঠছিল। তবে সব সত্ত্বেও সেটা একটা কার্যকর সম্পর্ক ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। সু চি তাঁর উর্দিধারী রাজনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে নানা সময়ে নানা বিষয়ে আপস করেছেন; এমনকি রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিপীড়ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র বিতর্কে তিনি নিজের ভাবমূর্তির বিরাট ক্ষতি স্বীকার করেও সামরিক বাহিনীর অবস্থানকে সমর্থন করেছেন।

পাশ্চাত্য দুনিয়ায় মানবাধিকারকর্মীসহ যাঁরা সু চির প্রশংসা করতেন, তাঁদের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ বলা হয়, এমনকি গণহত্যার চেষ্টা বলেও কেউ কেউ বলেন। সেই গুরুতর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে সু চি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ পর্যন্ত করেননি। এর ফলে বহির্বিশ্বে তাঁর ভাবমূর্তি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে জাত্যভিমান ও বর্ণবাদের অভিযোগ উঠেছে; এমনকি তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কার কেড়ে নেওয়ার দাবিও উঠেছিল।

বিজ্ঞাপন

তিনি সামরিক জান্তার হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এসব থেমেছে। অনেক দেশের সরকার তাঁর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তাঁর মুক্তি ও গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সামরিক বাহিনী দাবি করে চলেছে যে তারা সংবিধান মেনেই সবকিছু করেছে।

মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো উদ্বেগের সঙ্গে দেশটির উদ্ভূত পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে। ভারত সব সময়ই দেশটিতে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার চেয়েছে। ১৯৮৮ সালে সামরিক বাহিনী দেশব্যাপী বিক্ষোভ সহিংসভাবে দমন করলে ভারত মিয়ানমারের ছাত্রদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছিল, সেখান থেকে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালাতে সহায়তা করেছিল; গণতন্ত্রপন্থী সংবাদপত্র ও রেডিও স্টেশন পরিচালনায় সহায়তা করেছিল। কিন্তু চীন ও পাকিস্তান মিয়ানমারের জেনারেলদের সমর্থন করেছিল; চীন এমনকি উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিয়েছিল। তাতে ভারতের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল; ফলে ভারত সরাসরি ইয়াঙ্গুনের সেনাশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের অবস্থান সংহত করার বন্দোবস্ত করেছিল।

আজ চীন সু চির বেশি কাছাকাছি, আর ভারত চীনকে নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উদ্বেগ দেখে স্বস্তিতে আছে। ভারতে অনেক মনে করছেন, পাশের দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষেই দাঁড়ানো উচিত, কিন্তু অন্যদের পরামর্শ হলো সতর্ক থাকতে হবে, যেন মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আবার ১৯৮৮-২০০১ সময়কালের মতো না হয়ে যায়।

পাঠকের মতামত: